“কলকাতা” নামটি মনে পড়তেই একটি মায়াবী ছবি ভেসে ওঠে! সাদা ধবধবে কলকাতার ট্রাম চলা শহরের রাস্তা, ঐতিহ্যবাহী ভবনের চারপাশে গল্পের ঝিলিক, আর অল্প দামে পেটপুজোর ব্যবস্থা করানো অদ্ভুত কিছু জায়গা... ‘পাইস হোটেল’! আজকের এই আধুনিক, ঝকঝকে কলকাতায় এই পাইস হোটেলগুলো ঠিক কতটা প্রাসঙ্গিক, সেই প্রশ্নই হয়তো মাথায় আসে। তবে সত্যি কথা বলতে, কলকাতার চরিত্রকে বুঝতে হলে, তার ইতিহাসের স্বাদ নিতে হলে পাইস হোটেলের গল্প জানাটা জরুরি।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রায় ১০০ বছর আগে কলকাতা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান কেন্দ্রস্থল। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ আসতেন এই ‘স্বপ্নের শহরে’। কিন্তু তখনকার সাধারণ মানুষের পক্ষে আজকের মতো বিলাসবহুল রেস্তোরাঁর খাবার খাওয়া ছিল একদমই অসম্ভব। সেই সময়ই সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে জন্ম নেয় এই পাইস হোটেলগুলো। মাত্র কয়েক পয়সায় (পাইস বা পাই হিন্দিতে মানে ‘আনা’) সুস্বাদু, ঘরোয়া স্বাদের রান্নার মতো খাবার দিত এই হোটেলগুলো। সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম, জগন্নাথ আশ্রম, স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল, তরুণ নিকেতন – এমন আরো কত নাম তখন লোকের মুখে মুখে ঘুরত। প্রতিটি হোটেলেরই নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব রন্ধন শৈলী ছিল। কোথাও পাওয়া যায় হাঁসের ডিমের ডালনা, কোথাও আবার চিতল মাছের পেটি বা মাছের ডিমের বড়া। একই ছাদের তলায় বসে সবাই মিলে খাওয়া, আড্ডা দেওয়া – এই পাইস হোটেলগুলো হয়ে উঠেছিল সামাজিক মেলবন্ধন তৈরিরও অন্যতম মাধ্যম।
কিন্তু পাইস হোটেলের গুরুত্ব কেবল সস্তা খাবার আর আড্ডা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় হাজার হাজার মানুষ পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। খাদ্যের অভাব, আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে পাইস হোটেলগুলো দাঁড়িয়েছিল তাদের পাশে। সামান্য দামে খাবার সরবরাহ করেছিল অগণিত মানুষকে। এমনকি, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ও এই হোটেলগুলো গোপন আড্ডা হিসাবে ব্যাবহার করতেন বিপ্লবীরা। সময়ের সাথে কলকাতার চেহারা বদলেছে। ফাস্টফুডের দাপটে, আধুনিক রেস্তোরাঁয় ভিড় জমেছে কিন্তু পাইস হোটেল এখনো টিকে আছে । কিন্তু আজকের এই প্রতিযোগিতামূলক দুনিয়ায় তাদের অস্তিত্ব কি আজ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে ধরে ? আসলেই কি পুরনো ঐতিহ্যের এই স্বাক্ষীরা হারিয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার ঢেউয়ে? সত্যি কথা বলতে, চিত্রটা এতটা নিরাশাজনক নয়। এটা ঠিক যে আগের মতো প্রতিটি গলিতে পাইস হোটেল দেখা যায় না, তবে এখনো কিছু কিছু হোটেল টিকে আছে। সেই সব জায়গায় এখনো সেই ঐতিহ্যবাহী স্বাদ, সাদাসিধে পরিবেশ, আর আন্তরিক সেবা পাওয়া যায়। এমনকি, কিছু পাইস হোটেল আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে নিজেদের পুনর্নির্মাণ করেছে। নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার জন্য তারা ঐতিহ্যবাহী খাবারের পাশাপাশি নতুন পদও চালু করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের প্রচার করেছে। ফলে, এখন অনেক তরুণ-তরুণী এই পাইস হোটেলগুলোতে এসে ইতিহাসের স্বাদ নিতে আগ্রহী।
এই পুনর্জাগরণের আরও একটি কারণ হলো, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি। বাইরের রাস্তার ক্ষণস্থায়ী খাবারের চেয়ে অনেকেই এখন ঘরের মতন রান্না করা খাবার খেতে আগ্রহী। আর সেই চাহিদা পূরণই করছে এই পাইস হোটেলগুলো। তবে পাইস হোটেলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে কেবল ব্যবসায়ীদের চেষ্টাই যথেষ্ট নয়। সরকারি উদ্যোগও দরকার। এই ঐতিহ্যবাহী জায়গাগুলোকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া, তাদের পুনর্নির্মাণে আর্থিক সাহায্য করা – এমন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এছাড়াও, মানুষকেও আরো সচেতন হতে হবে। আমাদের উচিত এই ঐতিহ্যবাহী জায়গাগুলোতে যাওয়া, সেখানকার খাবার উপভোগ করা। কারণ, ইতিহাসকে জানা, বোঝা আমাদের দায়িত্ব। আর পাইস হোটেলগুলো সেই ইতিহাসেরই অংশ। শেষ পর্যন্ত, কলকাতার পাইস হোটেলগুলোর গুরুত্ব কেবল সস্তা খাবারের জায়গা হিসেবেই নয়। এগুলো আমাদের শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। প্রতিটি হোটেলের গল্পে মিশে আছে কলকাতার মানুষের জীবনযাত্রা, সংগ্রাম, আনন্দ। তাই, এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা, এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সকলেরই কর্তব্য। কারণ, ইতিহাসকে ভুলে গেলে ভবিষ্যৎ গড়া কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রথমেই, পাইস হোটেলগুলোকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার। এর জন্য প্রযুক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে। সুন্দর ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া পেজ তৈরি করে সেখানে তাদের ইতিহাস, পরিবেশ, খাবারের ছবি ও গল্প শেয়ার করা যেতে পারে। পাশাপাশি, বিভিন্ন ফুড ব্লগার, ইনফ্লুয়েন্সারদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে এই হোটেলগুলোকে প্রচার করার জন্য।
দ্বিতীয়ত, পাইস হোটেলগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায় বিশেষ কিছু আয়োজনের মাধ্যমে। যেমন, ঐতিহ্যবাহী খাবারের উৎসব, রান্নাঘরে ঢুঁ মারার সুযোগ, সঙ্গীতানুষ্ঠান, কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা – এমন কিছু কর্মসূচি আয়োজিত হতে পারে। এতে করে নতুন প্রজন্মের কাছে এই জায়গাগুলো আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
তৃতীয়ত, স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করা যেতে পারে। বিভিন্ন পাড়ার ক্লাব, স্কুল, কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের পাইস হোটেলগুলোতে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এতে করে ছোটবেলা থেকেই ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হবে নতুন প্রজন্ম।
পরিশেষে, বলতে হবে এই পাইস হোটেলগুলো কেবল ঐতিহ্যের সাক্ষীই নয়, ভবিষ্যতের সম্ভাবনারও প্রতীক। এখানে স্থানীয় খাবারের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ, ঐতিহ্যবাহী খাবারের সঙ্গে সঙ্গে কিছু নতুন রেসিপিও চালু করা যেতে পারে। এতে করে পুরনোদের অভিজ্ঞতা ও নতুনদের উদ্ভাবনী মিলিত হয়ে আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে এই পাইস হোটেলগুলো। কলকাতার পাইস হোটেলগুলো আমাদের শহরের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংযোগস্থল। ঐতিহ্যকে ধরে রাখা, নতুন প্রজন্মকে সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত করা – এ দায়িত্ব আমাদের সকলেরই। আসুন, সকলে মিলে হাত ধরে এগিয়ে যাই, বাঁচিয়ে রাখি কলকাতার এই ঐতিহ্যবাহী স্বাদকথা, "পাইস হোটেল"কে।