"নামের আমি , নামের তুমি। নাম দিয়ে যায় চেনা। " কথাটা কলকাতা শহরের ক্ষেত্রে আধা সত্যি আধা মিথ্যে। আমাদের এই তিলোত্তমা তে এমন কিছু জায়গা আছে যাদের নামকরণ হয়েছে তাদের কাজ দিয়ে ,আবার এমনও অনেক জায়গা আছে যার সঙ্গে তার নামের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যেমন "জোড়াবাগান " , নামেই আছে জোড়া আর বাগান মানে দুটো বাগান এর জায়গা। একটার মালিক গোবিন্দরাম মিত্র আর একটার মালিক উমিচাঁদ। আবার অন্যদিকে "ঠনঠনিয়া " বা "উল্টোডাঙা " নামের পিছনে বিশাল এবং প্রাচীন সব গল্প লুকিয়ে আছে। আসুন আজকে নামের জগতে পাড়ি জমাই । কথা দিচ্ছি , একবার নামের গল্পগুলো জানতে পারলে নামের সার্থকতা টের পাবেন।
শুরু করা যাক আমাদের তিলোত্তমা কে নিয়ে। বেশিরভাগ ইতিহাসবিদরা বলেন কলকাতার নাম এসেছে "কালী ক্ষেত্র " থেকে। যার অর্থ মা কালির জায়গা বা ক্ষেত্র। আরেক দল বলেন যে আসল নামটা "খাল কাটা " থেকে এসেছে। মারাঠারা যে খাল কেটেছিল তার থেকেই নামকরণ হয়েছিল।অবশ্য ইতিহাসবিদ থাংকাপ্পান নায়ার বলেছেন যে নামটা এসেছে ভৌগোলিক কারণে। হুগলি নদীর অনেক শাখা প্রশাখা ছিল আগেকার দিনে আর তার মাঝের জায়গা কে বলা হতো "কোল " , তাই সেখান থেকে নামকরণ হয় কাটা কোল বা কোল -কাটা।
উত্তর কলকাতার বিভিন্ন জায়গা জড়িয়ে আছে অনেক অজানা ইতিহাস। আহিরীটোলা কলকাতার সব চেয়ে পুরোনো জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম। পুরোনো সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে মজদুরদের বা গোয়ালাদের থাকার জায়গা হিসেবে ধার্য করে। এই জায়গার উল্লেখ ১৭৮৪ সালেও পাওয়া যায় অনেক সরকারি নথিতে। গোয়ালাদের কাজের জন্য অনেক রাতভরে উঠতে হতো। এই সময়টাকে বলা হতো "আহির " , আর " টোলা " অর্থ হলো জেলা বা বসতি। সেখান থেকে এই জায়গায় নাম হয় আহিরীটোলা।
লর্ড মিন্টো কে পরাধীন ভারতের ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করা হয় ১৯০৫ সালে। আমাদের মিন্টো পার্কের নামকরণ এনার নামেই হয়েছে যদিও লর্ড মিন্টোর করা মিন্টো-মরলে আইন ভারতীয় জনতা মোটেও ভালো ভাবে নেয়নি। মিন্টো পার্কের সরকারি নামটি অবশ্য শহীদ ভাগত সিং উদ্যান , তবুও জন স্মৃতিতে মিন্টো পার্ক নামটিই বেশি জনপ্রিয় রয়ে গেছে।
পুরোনো কালের কলকাতার মধ্যে দিয়ে অনেক ছোট খাঁড়ি বা নদী বয়ে যেত আগেকার দিনে আজকের ক্রিক রো যেখানে সেখান দিয়ে দিয়ে একটি রীতিমতো প্রসস্ত খাঁড়ি বয়ে যেত। ১৭৩৭ সালে ঘূর্ণিঝড়ে এই খাঁড়িতে একটি বিশাল জাহাজ ভেঙে পড়ে। সেই থেকে জায়গার আদি নাম হলো "ডিঙা ভাঙা "। পরের দিকে কোম্পানির রাজত্ব কালকে এটার নাম হয় "ক্রিক রো "। ক্রিক এর আক্ষরিক অর্থ হলো খাঁড়ি।
ব্রাবোর্ন রোড আর রবীন্দ্র সরণির মধ্যে এক ফালি রাস্তা , কিন্তু এখানে দেখা মিলবে পার্সি চার্চের। রাস্তা টির নামকরণ হয়েছে এককালের এখানকার প্রভাবশালী ইহুদি পরিবারের ওপর। ডেভিড জোসেফ এজরা আর এলিয়া ডেভিড। এনারা ইহুদি ছাত্রী স্কুল আর বহু ইমারত তৈরী করেছেন এই কলকাতার বুকে। জানেন কি , এস্প্লানেড ম্যানশন এবং চৌরঙ্গী ম্যানশন এনাদেরই নকশা করা। এ ছাড়াও আরো চারটি সিনাগগ এনারা বানিয়েছিলেন যেগুলো আজ অব্দি ব্যবহার করা হয়। বালিগঞ্জে অবস্থিত একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে আর্থার স্যামুয়েল লাভলকের নামে।লাভলোকের মৃত্যু হয় ১৮ নভেম্বর , ১৯০৩ সালে। খুব সম্মানীও আর ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন এবং ব্যবসায়ী মহল এনার প্রয়ানে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে। এনার সম্মানে এই রাস্তার নামকরণ হয় লাভলক স্ট্রিট।
স্বাধীনতার পূর্ব যুগে বাগবাজার এলাকা প্রাচীন কাল থেকেই বনেদিয়ানা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত। অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দী অব্দি বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য সংকৃতি মনস্ক মানুষদের আনাগোনা লেগে থাকতো। ১৯৫২ অব্দিও এই এলাকার উত্তর দিকে " পেরিন্স গার্ডেন" বলে একটি বাগান ছিল যেখানে কোম্পানি রাজে মেমসাহেবরা হাওয়া খেতে আসতেন। শোনা যায় সে বাগান এর বাহার এর কোনো তুলনা ছিলোনা। এইবাগানের ফুল এলাকার বাজারগুলো তে বিক্রি করা হতো। সেখান থেকে নাম পড়ে যায় "বাগবাজার "
বেলেঘাটার নাম নিয়ে দু রকম গল্প শোনা যায়। একটা এই যে এই জায়গার নাম করণ হয়েছে এখানকার খাঁড়ির পাশে পরে থাকা বালির চর থেকে। বালি ঘাটা থেকে অপভ্রংশ হয়ে বেলেঘাটা। অবশ্য ইতিহাসবিদ থাংকাপ্পান নায়ার বলেন যে এই জায়গার নাম হয়েছে এখানকার খাঁড়ি তে আশা বড় মালবাহী নৌকোর থেকে ,যেগুলোকে আগেকার দিনে "বুলে " বলা হতো। অতএব বুলেঘাট থেকে বেলিয়াঘাটা হয়ে আজকের বেলেঘাটা।
আজকের চিতপুর এলাকা নাটক পাড়া হিসেবেই বেশি পরিচিত। কিন্তু পুরাতন কালে চিতেশ্বরী কালী মন্দিরের নামে চিৎপুরের নাম পড়ে। এই মন্দির প্রতিষ্টা করেন গোবিন্দরাম মিত্র ,কিন্তু ১৭২৭ সালের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে এই মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। আরেক মতে শোনা যায় যে এই জায়গার নামকরণ হয়েছে "চিতে ডাকাত " এর নামে। এই চিতে ডাকাত নাকি মানুষ বলি দিত মা চিতেশ্বরী কে তুষ্ট করতে। কিন্তু চলতি সময়ে দেখা গেছে যে চিৎপুর যাত্রাপালা আর থিয়েটার শিল্পের পীঠস্থান। সেই ষোড়শ দশক থেকে এখানে বহু নামি ও গুণী শিল্পীরা থাকতেন। সেই থেকে এই জায়গার নাম হয়ে যায় "চিত্রপুর " এবং লোকের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে জায়গার নাম হয়ে দাঁড়ায় আজকে "চিৎপুর " এ। এই জায়গার উল্লেখ পাওয়া যায় বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসামঙ্গল কাব্যেও।
ধর্মতলা বললেই চোখে ভেঁসে ওঠে একটা জমজমাট জনজীবনের ছবি।ধর্মতলা নামটার সঙ্গে যোগ আছে ধর্মঠাকুরের। গ্রাম্য বাংলা তে এই দেবতা কে পুজো করা হতো। হরি ও ডোম সম্প্রদায় এই দেবতার উপাসক এবং এই এলাকায় থাকতো আগেকার দিনে।তাই এই জায়গার নাম পড়ে যায় "ধর্ম টোলা "। আজকে ধর্মতলা এই নামেরই অপভ্রংশ।
হিন্তাল গাছের নাম শুনেছেন আগে ?এন্টালি এলাকায় আগেকার দিনে একরকম গাছ এর দেখা মিলতো এক রকমের খেজুর গাছ যার নাম হলো "হিন্তাল "। সেই গাছ থেকে এলাকার নাম পড়লো হিন্টালি। সেই হিন্টালি লোক মুখে ফিরে আজকের এন্টালি হয়ে উঠেছে। তবে অনেকের মতে এন্টালি নামটি আসলে এনায়েত আলী নাম অপভ্রংশ। এনায়েত আলী বাজার এই এলাকার একদম মাঝামাঝি ছিল এক সময়ে।
নবাব সিরাজুদ্দৌলাহ আর কলকাতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অংকে লম্ব আর রক্তাক্ত ইতিহাস। নবাব কলকাতা আক্রমণ করেন ১৭৫৬ সালে। উনি চেয়েছিলেন যে ওনার হাতিগুলো এমন জায়গায় থাকুক যেখান থেকে নদী কাছে পড়ে। হাতিবাগান নামে যে জায়গা আমরা আজকে চিনি সেখানে উনি হাতিদের রেখেছিলেন। তাই এই জায়গার নাম পড়ে হাতিবাগান।
লালবাজার বলতে আমাদের কলকাতা পুলিশের পীঠস্থানই বুঝি। যদিও সেখানে কিন্তু কস্মিন কালেও কোনো বাজার ছিল না। লাল বাজার নাম হয়েছিল দুটো কারণে। এখানে মূলত সেনাদের ছাউনি , খাবার দোকান আর বেশ্যালয় ছিল। সেই আমোদ প্রমোদের জায়গাগুলো তে জলের মতন লাল ওয়াইন বা সূরা পরিবেশন করা হতো যার রং গাঢ় লাল। সেই লাল রং থেকে নামকরণ "লালবাজার "।আরেকমত হলো যে দীঘি তে মহাকরণের লাল রং প্রতিফলিত হয়ে জায়গাটা লাল আভায় ভরে থাকায় জায়গার নাম হয়ে যায় লালবাজার।
যে বাজারে রাজা যায় সেই বাজারই "রাজাবাজার"। বাজারটির নাম ছিল আসলে রাজা রামলোচনের বাজার। আর এই জায়গাতেই রাজা রাজবল্লভ কোম্পানির থেকে নবাব সিরাজুদ্দৌল্লাহের থেকে সুরক্ষা বা পাহারা চেয়েছিলেন এবং কোম্পানি তাকে সেটা দিয়েছিলো।
আজকের শিয়ালদহ কে কলকাতা শহরের একটা মূল প্রবেশদ্বার বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হয়না। বিশেষত উত্তর শহরতলির কথা যদি ধরা যায় শিয়ালদহের আদি নাম ছিল শৃগালদ্বীপ। প্রকৃত অর্থেই শৃগাল দের দ্বীপ। প্রচুর পরিমানে শেয়াল পাওয়া যেত এই সমতল দ্বীপে। এও শোনা যায় যে এখানে নাকি শেয়ালদের দাহ করা হতো তাই নাম পড়েছে "শিয়ালদহ "।
জানেন কি কলকাতার শহরের বুকে প্রথম ট্রাম কোথায় চলেছিল? কলকাতা শহরের প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলেছিল শ্যামবাজারে। এখানে কোম্পানির রাজে চার্লস বাজার নাম একটি বাজার ছিল যেটার পরবর্তী কালে নাম দেওয়া হয় বসাক বাড়ির শ্যাম রায়ের নামে। এই বসাক পরিবার ছিল কলকাতার অন্যতম বড় এবং বিখ্যাত ব্যবসায়ী পরিবার।সেই বাজার ও তার পার্শবর্তী এলাকাও শ্যামবাজার নামেই পরবর্তী কালে পরিচিত হয়।
ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি চেনেনা এমন লোক আমাদের শহরে পাওয়া মুশকিল ঠনঠনিয়া এলাকা কুখ্যাত ছিল শক্ত এবং এঁটেল মাটির জন্য , যা নাকি ইঁটের মতন শক্ত ছিল। সেই মাটির ঢেলা নাকি একে ওপরে ঠোকাঠুকি করলে ঠন ঠন করে আওয়াজ হতো। অতএব জায়গার নাম হলো "ঠনঠনিয়া "। শরৎ চন্দ্র মিত্র মহাশয় অবশ্য উল্লেখ করেছেন যে ঠনঠনিয়ার নাম পড়েছিল সেখানে ব্রাস জাতীয় ধাতুর কারিগর যাদেরকে "ঠুনঠুরিয়া" বলতো তাদের নামে। এই এলাকী নাকি এই কারিগরদের রমরমা ছিল এককালে।
খিজর বা ক্ষিদ্র বলা হতো সেই দেবতা কে যিনি সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া নাবিকদের রক্ষা করতেন। তারই অপভ্রংশ হলো খিদির আর এই খিদিরপুর নাম হয় ওনার নামে। অবশ্য বন্দর এলাকা হওয়ার দরুন এই জায়গার নাম লর্ড কিদের নাম নামকরণ করা হতে পারে এরকম অনেকেই মনে করেন। তার কারণ এই লর্ড কিড সেই ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন যিনি এই বন্দর আর তার লক গেটের নকশা তৈরী করেন। এইখানেই লর্ড ওয়াটসন এর তত্ত্বাবধানে প্রথম ব্রিজ তৈরী করেন এই কলকাতা শহরের বুকে।
একটি বড় মাটির ঢিপি ছিল যেটা আলীগড় কেল্লার কাছে অবস্থিত ছিল।সেই ঢিপির মাথায় উঠে চারিদিকে নজরদারি করার কাজ চলতো। সেই মাটির ঢিপি কে বলা হতো "মাটিয়াবুরজ "'উর্দুতে বুর্জ কথার অর্থ ঢিপি। এই মাটিয়াবুরজ কালে কালে ইংরেজদের কাছে হয়ে দাঁড়ালো " মেটিয়াবুরুজ "।
কর্নেল উইলিয়াম টলি একটি বাজার তৈরী করেন এই এলাকায়। নিশ্চয় ধরে ফেলেছেন কোন জায়গার কথা বলছি। হ্যাঁ , ঠিক ধরেছেন , সেই বাজারটি পরিচিত হয় টালিগঞ্জ নামে। কর্নেল টলি আদি গঙ্গা মানে এখনকার টালি নালা তৈরী করিয়েছিলেন যা যুক্ত করতো কলকাতা বন্দর ও মামলা আর বিদ্যাধরী নদীকে।
এই হলো আমাদের কলকাতার বিভিন্ন এলাকার নামকরণের বৃত্তান্ত । এরকম আরো কত না জানা ইতিহাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই শহরের অলি গলি আনাচে কানাচে। এইসব ইতিহাসের সাক্ষর বুকে বয়ে নিয়ে চলেছে আমাদের শহর ,আমাদের তিলোত্তমা।