একুশ শতকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যখন নারীর অধিকার আর স্বাধীনতার কথা বলি, তখন প্রায়শই ভুলে যাই সেই সব পথিকৃৎদের কথা, যাঁরা শত বছর আগে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এই আধুনিকতার ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন। এমনই এক প্রমিলা ছিলেন কূচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবী, যাঁর জীবন একাধারে রাজকীয় আভিজাত্য, ব্যক্তিগত বিতর্ক এবং এক গভীর সামাজিক দায়বদ্ধতার নিখুঁত সংমিশ্রণ । তাঁর জীবনের গল্প শুধু একটি রাজকীয় উপাখ্যান নয়, এটি নারীর ক্ষমতায়ন আর অগ্রগতির এক উজ্জ্বল দলিল।
সুনীতি দেবীর জন্ম ১৮৬৪ সালে কলকাতার এক আলোকিত পরিবারে । তিনি ছিলেন কেশব চন্দ্র সেনের কন্যা, যিনি এক সময় ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এবং বাংলার নবজাগরণের এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ ছিলেন । ব্রাহ্ম সমাজ ছিল এমন এক আন্দোলন যা নারীদের শিক্ষা, সমানাধিকার এবং কুসংস্কারমুক্ত সমাজের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল । এমনই এক প্রগতিশীল পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন সুনীতি । তাঁর শিক্ষা ছিল "ব্যাপক ও বিচিত্র" । এমনকি তিনি বেথুন স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন, যা ছিল ভারতের প্রথম দিককার বালিকা বিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম । মাত্র বারো বছর বয়সে তাঁর মনে সন্ন্যাসিনীদের জীবন গভীর প্রভাব ফেলেছিল, এবং তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন "চতুর হতে, অনেক বেশি ভ্রমণ করতে এবং এক প্রকার সন্ন্যাসিনী হতে" —এই প্রতিজ্ঞা তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের সামাজিক সেবার এক আগাম ইঙ্গিত ছিল।
তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় ১৮৭৮ সালে, যখন মাত্র চৌদ্দো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় কূচবিহারের পনেরো বছরের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে । এটি কেবল একটি বিয়ে ছিল না, এটি ছিল এক রাজনৈতিক ও সামাজিক ঝড়। এই বিয়ে ব্রাহ্ম বিবাহ আইন ১৮৭২-এর সরাসরি লঙ্ঘন ছিল, যে আইনটি তাঁর বাবা নিজেই প্রণয়ন করেছিলেন । এই ঘটনাকে সমালোচকরা "ব্রাহ্ম মূল্যবোধের মৌলিক বিশ্বাসঘাতকতা" বলে অভিহিত করেন এবং এর ফলে ব্রাহ্ম সমাজে এক গুরুতর বিভাজন দেখা দেয় । এই বিতর্ক কেশব চন্দ্র সেনের সুনামের অপূরণীয় ক্ষতি করলেও, সুনীতি দেবীকে এক নতুন এবং শক্তিশালী মঞ্চে নিয়ে আসে, যেখানে তিনি তাঁর শৈশবের প্রগতিশীল আদর্শগুলিকে বাস্তবায়িত করার সুযোগ পান ।
কূচবিহারের মহারানি হয়ে ওঠার পর তিনি তাঁর রাজপদকে ব্যক্তিগত আরামের পরিবর্তে সামাজিক পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি নারীর অধিকার এবং বিশেষত শিক্ষার একজন অনুরাগী সমর্থক ছিলেন । কূচবিহারের রাজপরিবার এমনিতেই তাদের "পশ্চিমা এবং প্রগতিশীল" মনোভাবের জন্য সুপরিচিত ছিল । এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সুনীতি দেবী ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত সানিটি অ্যাকাডেমিকে এগিয়ে নিয়ে যান । স্কুলটি মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত হলেও, এর নেপথ্যে মূল ভাবনা ছিল মহারানিরই ।
কিন্তু তাঁর প্রগতিশীলতার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ছিল সমাজের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সংস্কারের পথ বেছে নেওয়া । সে সময় পর্দার আড়ালে থাকা মেয়েদের পড়াশোনার জন্য তিনি এক অসাধারণ কৌশল অবলম্বন করেন। মেয়েদের বাড়ি থেকে স্কুলে আনা-নেওয়ার জন্য তিনি রাজপ্রাসাদের গাড়ির ব্যবস্থা করেন, এবং সামাজিক বিতর্ক এড়ানোর জন্য সেই গাড়িগুলোর জানালায় পর্দা লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন । এই সহজ অথচ বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি রক্ষণশীলতার প্রতি সম্মান রেখেও আধুনিক শিক্ষাকে সাধারণের মধ্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন । তাঁর এই দূরদর্শিতা প্রমাণ করে যে, সংস্কার শুধু বিদ্রোহের মাধ্যমে হয় না, বরং বাস্তবসম্মত এবং সংবেদনশীল পদক্ষেপের মাধ্যমেও তা সম্ভব ।
কূচবিহারের বাইরেও সুনীতি দেবীর প্রভাব ছিল ব্যাপক। তাঁর বোন ময়ূরভঞ্জের মহারানি সুচারু দেবীর সঙ্গে যৌথভাবে তিনি ১৯০৮ সালে দার্জিলিং-এ মহারানি গার্লস হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি স্কুলগুলোর জন্য বার্ষিক অনুদান দিতেন, মেয়েদের বেতন মওকুফ করতেন এবং সফল ছাত্রীদের পুরস্কৃত করতেন । ১৯৩২ সালে তিনি ‘অল বেঙ্গল উইমেনস ইউনিয়ন’-এর প্রথম প্রেসিডেন্ট হন, যা বাল্যবিবাহ বন্ধ এবং নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য কাজ করত ।
সুনীতি দেবী কেবল একজন সমাজ সংস্কারক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সফল লেখিকাও । তাঁর বইগুলি, যেমন The Autobiography of an Indian Princess এবং The Beautiful Mogul Princesses তাঁর সময়ের এক মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল । তাঁর লেখায় সেই সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভাবের মধ্যে এক ভারতীয় রাজকন্যার জীবনের জটিলতা উঠে আসে ।তিনি ছিলেন একাধারে একজন সাংস্কৃতিক দূতও । ১৮৯৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়ার ডায়মন্ড জুবিলি এবং ১৯১১ সালে দিল্লি দরবারে তাঁর মার্জিত ও রাজকীয় উপস্থিতি ভারতের সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছিল । ১৮৮৭ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় নারী হিসেবে 'কম্পানিয়ন অফ দি অর্ডার অফ দি ইন্ডিয়ান এম্পায়ার' (CIE) উপাধি লাভ করেন , যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটি সেতুবন্ধনকারী হিসেবে তাঁর অনন্য অবস্থানকে তুলে ধরে ।
মহারানি সুনীতি দেবীর জীবন প্রমাণ করে যে, সাহস, বিশ্বাস এবং বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব কোনো নির্দিষ্ট সীমানায় আবদ্ধ থাকে না। তিনি তাঁর রাজকীয় পদমর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে অসংখ্য নারীর জীবনকে আলোকিত করেছেন। তাঁর উত্তরাধিকার কেবল তাঁর কাজকর্মে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাঁর পরিবারেও তা প্রবাহিত হয়েছে। তিনি ছিলেন কিংবদন্তি মহারানি গায়ত্রী দেবীর দিদিমা 10। তাঁর হাত ধরেই ব্রাহ্ম সমাজের প্রগতিশীল আদর্শগুলি নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছিল, যা আজও আমাদেরকে অনুপ্রেরণা যোগায় ।