শুধু শারদীয় পুজোর আলোয় ঝলমলে হয়ে উঠছে না বাংলা। আজ আরো এক নতুন আলো , দেখা যাচ্ছে এই লাল মাটির প্রান্তরে। অ্যাপার্টমেন্টের দেয়াল জুড়ে নিছক ডিজিটাল দুর্গামণ্ডপ বানানো ছেলেটির গল্প নয়, আজ বলব সেই তরুণের কথা, যে তার বুদ্ধিকে মূলধন করে একটা স্টার্ট আপ গড়ে তুলেছে। অ্যালগোরিদমের পুজো, ডেটাবেসের মণ্ডপ – এই হলো আজকের বাংলার নতুন উৎসব, নতুন ঝলক।
পুরোনো দিনের গল্প আর নয়, আজকের যুবকরা ডিজাইন করছে এআই-চালিত রোবট, যা চমকে দেবে আপনাকে! গরম কচুরির গন্ধে ম ম করে উঠা বাজার নয়, আজ ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে চাষবাদ শিখছে বাংলার কৃষক, গ্রামগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল কৃষি-হাট! তরুণ বাংলা আর সেই পুরনো বাংলা – এক আকাশের দুই প্রান্ত, কিন্তু উভয়ের চোখেই জ্বলছে একই স্বপ্ন, একই দৃষ্টিভঙ্গি – গড়ার স্বপ্ন, সাফল্যের পথচলা।
শুধু কথাই নয়, পরিসংখ্যানও বলে একই গল্প। ২০২৩ সালে, ভারতের স্টার্ট আপ ইকোসিস্টেমে বাংলা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। প্রায় ৮ হাজারের বেশি স্টার্ট আপ কোম্পানি, ৫ লক্ষের বেশি কর্মসংস্থান – এই সংখ্যায়ই গল্প বলা হচ্ছে বাংলার যুবকদের উত্থানের, তাদের হাতে থাকা ডিজিটাল অস্ত্রের কাহিনী।
কিন্তু কী সেই আগুন, কী সেই প্রেরণা, যা তরুণ বাংলাকে এমন করে জ্বালিয়ে তুলেছে?
ইন্টারনেটের বিপ্লব: ইন্টারনেট আর স্মার্টফোন – এই দুটো ঝড় তুলেছে বাংলার সমাজে। শহর থেকে গ্রাম, সব জায়গাতেই পৌঁছে গেছে ডিজিটাল ঢেউ। জ্ঞান, তথ্য, সুযোগ – সবকিছুই আজ ইন্টারনেট আঙিনায় এসে ঠেকছে। আর তাই গ্রামের ছেলেমেয়েরাও স্বপ্ন দেখতে শিখেছে, ঝুঁকি নিতে শিখেছে।
সরকারি উদ্যোগ: শুধু তরুণরাই না, সরকারও এগিয়ে এসেছে হাত বাড়িয়ে। ইনকিউবেটর, স্টার্ট আপ হাব, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম – নানাভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে তরুণ উদ্যোক্তাদের। এমনকি, বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে বিশেষ পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা: 'চাকরি করব' - বাক্যটা আর লেখা নেই এই তরুণদের ডিকশিনারি তে।
গ্লোবাল চিন্তা, লোকাল সমাধান: শুধু শহর নয়, গ্রামের সমস্যা সমাধানেও হাত লাগাচ্ছে এই তরুণ উদ্যোক্তারা। সোলার পাম্প চালিত সেচ ব্যবস্থা, টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়া, ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের বাজার খুঁজে দেওয়া – এমন নানা উদ্ভাবনী কাজ করছে তারা।
মিলেনিয়াল মাইন্ডসেট: চাকরির নিরাপত্তার চেয়ে আজকের তরুণ চায় স্বাধীনতা, চায় নতুন কিছু করার রোমাঞ্চক। ব্যর্থতার ভয় কম, সফলতার আশা বেশি। এই মনোভাব তাদের ঝুঁকি নিতে উৎসাহিত করে।
নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব: মুখস্থ থেকে সরে এসেছে আজকের শিক্ষা, গেছে হাতে-কলমে শেখার পথে । কোডিং থেকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, শেখার বিষয় আর ক্লাসরুমের ছোঁকায় আটকে নেই। এই নতুন শিক্ষাই বাংলার তরুণদের স্টার্ট আপ জগতে ঝাঁপিয়ে ঠেকাতে সাহায্য করছে।
কমিউনিটির সমর্থন: আজ আর একা নেই তরুণ উদ্যোক্তারা। স্টার্ট আপ কমিউনিটি, মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম, নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট – নানা পথে পাশে আছে সহায়ক হাত। এই গোষ্ঠীতে জ্ঞান বিনিময়, অভিজ্ঞতা ভাগ, সমস্যা সমাধান – সবই হয়, হাত ধরে এগিয়ে চলে এই নতুন যুগের পথিকৃৎরা।
সফল গল্পের অনুপ্রেরণা: কুণাল বাবু, সৌম্য দত্ত, ঋত্বিক সেন – এমন নানা উদ্যোক্তার সফল গল্প বাংলার যুবকদের চোখে জ্বলজ্বলে স্বপ্ন এঁকে দিচ্ছে। 'যদি তারা পারে, তবে আমরা কেন পারব না?' – এই চ্যালেঞ্জই তাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ: আইডিয়া ভালো থাকলে, দক্ষতা থাকলে, আর কোন অভাব? বাংলার স্টার্ট আপ ইকোসিস্টেমে উঠছে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ। এঞ্জেল ইনভেস্টর থেকে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম – সবাই খুঁজছে নতুন উদ্ভাবন, নতুন প্রতিভা।
স্বদেশ ভালোবাসার ভাবনা: শুধু টাকা লাভ নয়, সমাজ পরিবর্তনের ইচ্ছাও আছে অনেক তরুণের মনে। পরিবেশ রক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন – এমন সামাজিক উদ্দেশ্যকে মূলধন করেও গড়ে উঠছে অনেক স্টার্ট আপ।
এই তো কদিন আগেই, বুড়োকাকার চায়ের দোকানে টেলিভিশনে ঝকমকিয়ে উঠত এক বিজ্ঞাপন - চাকরিই শ্রেষ্ঠ পেশা, সরকারি চাকরি আরও শ্রেষ্ঠ! ছেলেবেলাটা কেটে যেত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সিভিল সার্ভেন্ট হওয়ার স্বপ্নে। কিন্তু আজকের বাংলা, অন্য এক গল্প বলছে। আজ এখানে চাকরি খুঁজে বসার চল আর নেই, আছে স্বপ্ন বুকে নিয়ে, নিজের পথ তৈরি করার উদ্যম। আর এই উদ্যমের ঝর্ণাধারে ঢেউ তুলে চলেছে বাংলার তরুণ প্রজন্ম।
কলকাতা থেকে দার্জিলিং, সুন্দরবন থেকে পুরুলিয়া, সারা বাংলা জুড়েই ফুটে উঠছে নতুন উদ্যোগ। ছোট শহরের ছেলেমেয়েরা ল্যাপটপ স্ক্রিনে বিশ্ব দেখছে, বিশ্ব বদলানোর স্বপ্ন দেখছে। তাদের হাতে কোড, ক্যানভাস, মৃৎ, লতা, প্রযুক্তি, কবিতা, সবই অস্ত্র। আর মনে এক দৃঢ় বিশ্বাস - নিজের চেষ্টায়, নিজের মেধায় গড়ে নিতে হবে সফলতা।
এক ঝলক দেখুন না, রুবেকা ঘোষের দিকে। আড়াইশ চোখের স্বপ্ন, হাতে ল্যাপটপ নিয়ে গ্রামের মেয়ে রুবেকা দাঁড় করিয়েছেন নিজের সফ্টওয়্যার কোম্পানি। ঝাড়খণ্ডের লাতেহার জেলা থেকে বাংলাদেশ, ভুটান পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে তাঁর ক্লায়েন্ট। আবার আছেন সৌরভ মজুমদার, বর্ধমানের ছেলে, যিনি তৈরি করেছেন 'আদিবাসী আর্ট' নামের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে আদিবাসী শিল্পীরা বসে বসে বিক্রি করছেন তাঁদের হস্তশিল্প, সারা পৃথিবী জুড়ে।
কিন্তু শুধু টেক এবং আর্ট নয়, বাংলার এই উদ্যমের ঢেউয়ে ঢাকা আছে নানা রকম গল্প। আছে জয়তী ঘোষ, যিনি চা-বাগানের বর্জ্য পাতা দিয়ে তৈরি করছেন জৈব প্লেট, হাতে হাতে বাঁচাচ্ছেন পরিবেশ। আছেন অঙ্কিত পাল, ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে যিনি গ্রামে ফিরে চাষবাসকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করেছেন। এই সব তরুণদের গল্পে আছে অনেক অনিশ্চয়তা, আছে বাধা, আছে ব্যর্থতার ছায়া। কিন্তু আছে সাহস, আছে জেদ, আছে এক নিঃশব্দ প্রত্যয় - 'আমি পারবো'। এই প্রত্যয়েই কেঁপে উঠছে বাংলার ভবিষ্যৎ।
উদ্যমের কথা না হয় গেল কিন্তু ঝুঁকি নেওয়ার কথা তো বললেন না ? ঝুঁকিই তো উদ্যোগের প্রাণ।
সুদ্বির বন্দ্যোপাধ্যায়, এক উদ্যোম পুঁজি বিনিয়োগ সংস্থার প্রধান, বলছিলেন, "বাংলার এই তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতিভা অসীম, কিন্তু অনেক সময় টাকা, পরামর্শ, নেটওয়ার্কের অভাবে তা পথ হারিয়ে ফেলে।" তাই আজকের দিনে বাংলার উদ্যমের ধারা অটুট রাখতে দরকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া দরকার
বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানো: সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ নিয়ে বেশি বেশি অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর, ভেনচার ক্যাপিটাল ফার্ম বাংলায় আসার পথ সুগম করতে হবে। সহজ শর্তে লোন, গ্রান্ট, সাবসিডি প্রদান করে তরুণ উদ্যোক্তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড শক্ত করতে হবে।
ইনকিউবেটর ও অ্যাক্সিলারেটরের বিস্তার: সারা বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও বেশি ইনকিউবেটর ও অ্যাক্সিলারেটর গড়ে তুলতে হবে। এই কেন্দ্রগুলো তরুণ উদ্যোক্তাদের বিনামূল্যে অফিস স্থান, মেন্টরশিপ, বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে তাদের পথ সহজ করবে।
প্রযুক্তিগত সহায়তা: সরকারি উদ্যোগে তথ্যপ্রযুক্তি, ক্লাউড কম্পিউটিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রযুক্তিগত ট্রেনিং, ওয়ার্কশপের আয়োজন করা জরুরি।
নেটওয়ার্কিংয়ের গুরুত্ব: বিভিন্ন শিল্পোদ্যোগ সংস্থা, ব্যবসায়ী সংঘ, সরকারি সংস্থার সঙ্গে তরুণ উদ্যোক্তাদের সংযোগ ঘটাতে হবে। নিয়মিত সেমিনার, কনফারেন্সের আয়োজন করে তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ দিতে হবে।
শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন: শিক্ষা ব্যবস্থায় উদ্যমশীলতা, ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা, সৃষ্টিধর্মী চিন্তারকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইন্টার্নশিপ, উদ্যোক্তা কোর্সের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হলে বাংলার তরুণ উদ্যোক্তারা দুনিয়ায় ঝড় তুলে ফেলতে পারবেন। তাদের উদ্ভাবন, তাদের প্রতিভা একদিন বাংলাকে গর্বিত করবে, বিশ্বকে অবাক করবে।
এই গল্প শেষ হয় না এখানে। বাংলার উদ্যোমের ধারা অবিরাম, গতি তুলছে ক্রমশ। একদিন বাংলা হয়ে উঠবে উদ্যোক্তাদের স্বর্গ, সৃষ্টিশীলতার মহাপীঠ। তখন প্রতি গ্রামে উঠবে ছোট ছোট কারখানা, ঝলমল করবে উৎপাদন, ছড়িয়ে পড়বে সফলতার গন্ধ। কৃষক আর ঝাড়ু শুধু ফসল ফলাবে না, তা মূল্যায়িত করে বিক্রি করবে নিজের ব্র্যান্ডে। গৃহিনীরা রান্নাঘরের গন্ধকে ব্যবসার সুগন্ধে পরিণত করবে। শিল্পীরা তুলির ছন্দে জীবন্ত করবে বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার স্বপ্ন।
এই স্বপ্নকে সত্যি করতে শুধু তরুণদের উদ্যমই যথেষ্ট নয়। দরকার আমাদের সবার সমর্থন, সহযোগিতা। পিতামাতারা ছেলেমেয়েদের উদ্যোগকে উৎসাহিত করুক, ঝুঁকি নিতে শেখাবে। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে শুধু পাঠ্যপুস্তকের পাঠ না দিয়ে, স্বপ্ন দেখতে শেখাবে, উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প শোনাবে। সমাজ ছেলেমেয়েদের ব্যর্থতাকে তिरস্কার না করে, শেখার সুযোগ হিসেবে দেখুক। আসুন, আমরা সবাই মিলে হাত লাগাই। তৈরি করি বাংলাকে উদ্যোক্তাদের লালনক্ষেত্র, সৃষ্টিশীলতার উৎস। বাংলার ঝর্ণাধারা কে আরও প্রবল, আরও বিশাল করি। তবেই একদিন দুনিয়া বলবে, 'বাংলা হল উদ্যোগের আঁতুরঘর, স্বপ্নের কারখানা!'
এই নিবন্ধের শেষ কথা এখানেই নয়। বাংলার উদ্যোমের গল্প অব্যাহত, প্রতিদিন নতুন নতুন অধ্যায় যুক্ত হচ্ছে। আমরা সবাই এই গল্পের অংশ। আসুন, আমরা মিলে লিখি বাংলার উদ্যোমের মহাকাব্য, যা অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে আগামী প্রজন্মের জন্য।