আবার ঘুরতে যাওয়ার ভূতটা মাথায় চেপেছে আমাদের সবার। মনটা খালি পালিয়ে যাই পালিয়ে যাই করছে। নতুন জায়গা খুঁজতে খুঁজতে হটাৎ এক বন্ধু বললো "বিচিত্রপুর" যাওয়া যাক ! এ কি বিচিত্র নাম রে বাবা। বিচিত্রপুর। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো বেশি দূর নয় জায়গাটা আর তার সঙ্গে আবার ম্যানগ্রোভ হিসেবে বেশ নাম ডাক ও আছে। বিচিত্রপুরের অবস্থান দিঘার থেকে ১৫ কিমি দূরে , তাই আর ভাবনা চিন্তা না করে টুক করে টিকেট কেটে তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেসে চেপে পড়লাম আমরা কজন ভ্রমণ পাগলা মানুষ।
দিঘা পৌঁছে গেলাম একদম ঠিক টাইমে । পৌঁছেই পেটের খিদে যেন দ্বিগুন বেড়ে গেলো সামান্য কিছু জলযোগ করে এবার খোঁজ করলাম কি করে আমরা বিচিত্রপুর পৌঁছতে পারি। থাকার জায়গা একটাই আছে এখানে। উড়িষ্যা সরকারের একটি রিসোর্ট। বিচিত্রপুর ফরেস্ট রিসোর্ট। এ সি কটেজ আর এ সি সুইস টেন্টের ব্যবস্থা আছে। ঘরের ভাড়াতে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ আর ডিনার ধরা আছে তাই খাবার নিয়ে চিন্তা নেই। তবে আগে থেকে কিন্তু বুকিং করে যাওয়াই ভালো। দিঘা স্টেশন থেকে বেরিয়েই আপনি বিচিত্রপুর যাওয়ার টোটো পেয়ে যাবেন। টোটো করে পৌঁছতে আধ ঘন্টা লাগলো।
বিচিত্রপুর জায়গাটা একটি মোহনার কাছে। এখানে বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে সুবর্ণরেখা নদী।মোহনা হওয়ার কারণে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল এর বাহার দারুন এখানে। প্রচুর গাছ গাছালি আর অনেক রকম জীবের দেখা পাওয়া যায়। শীতকালে এখানে লাল কাঁকড়া আর হর্স শু কাঁকড়ার দেখা পাওয়া যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে কাঁকড়া বালির সৈকতে দেখতে পাবেন। সারস জাতীয় অনেক রকমের পাখির ঝাঁক ও চোখে পড়ে যেতে পারে।ম্যানগ্রোভ ঘোরার জন্য এখানে বোটিংয়ের ব্যবস্থা আছে। রিসোর্টে আগের দিন বলে রাখতে হয়, টিকিটের ব্যবস্থা ওখানেই হয়ে যায় । মোটর লাগানো বোটে করে খাঁড়ি আর কাছের একটি ম্যানগ্রোভ দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়। সবাই সকাল ১০ টার মধ্যে বোটের ঘাটে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু পৌঁছে দেখি বোটিং বন্ধ !! সর্বনাশ ! যার জন্য এতো দূর থেকে এলাম সেটাই বন্ধ ? খোঁজ নিয়ে জানলাম বন্ধ শুধু জোয়ারের সময় টা কারণ জোয়ারের জলে দ্বীপ নাকি ডুবে যায় ,শুধু গাছগুলো জলের ওপর মাথা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।প্রায় এক ঘন্টা পরে আমাদের সুযোগ হলো বোটে উঠে রওনা হওয়ার। এক ঘন্টা ঘোড়া যায় দ্বীপে তারপর বোটে করে আবার ঘটে ফেরত আসতে হয়। যাত্রা শুরু করতেই আপনার সুন্দরবনের কথা মনে পড়তে বাধ্য।
প্রকৃতির দৃশ্য অনেকটা এক রকম। যেতে যেতে চোখে পড়তে পারে কাঁকড়া , সারস প্রভৃতি আরো অনেক নাম না জানা পাখির। এখানে শীতকালে শুনলাম অনেকরকমের কচ্ছপের দেখা পাওয়া যায়। আমরা কথা বলতে বলতেই দ্বীপে চলে এলাম। দ্বীপ টা একদম মোহনার ওপরেই। দ্বীপে দৃশ্য দেখে আমরা কিন্তু অবাক হলাম। মনে হচ্ছে অদ্ভুত এক জগতে প্রবেশ করেছি। মোটা মোটা কান্ডর গাছে ভর্তি দ্বীপ কিছু গাছের পাতা ঝরে পড়েছে আর কিছু গাছ আবার পাতায় ভর্তি। দ্বীপের সমতল কিন্তু পুরোটাই জলের তলায় থাকতে একটু নরম । কিন্তু দ্বীপের পুরোটা কিন্তু ঘন জঙ্গলে ঢাকা না ,মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গা আছে কিছু কিছু। যেখানে ফাঁকা সেখানে রোদ পড়ে জায়গাটা আলো হয়ে আছে , কিন্তু যেখানে গাছের ঘনত্ব বেশি সেখানে বেশ অন্ধকার হয়ে আছে। একটা বেশ এল আঁধারির খেলা চলছিল। প্রথা মতন সেলফি আর ফটো সেশন শুরু হয়ে গেছে। ভাঙা গাছের ডালে উঠে বেশি কেরামতি করে ফটো তুলতে গিয়ে আমার এক বন্ধু আছাড় খেলো। কিন্তু মাটি নরম হওয়াতে সেরকম কিছু বিপত্তি ঘটেনি। ঘুরে ঘটে যখন ফিরে এলাম তখন দেখি ৪-৫টা দোকান বসে গেছে সেখানে। আসে পাশের গ্রামের মানুষের নিজেদের হাতের তৈরী হস্তশিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছে। হাতের কাজ দেখে কিন্তু তারিফ করতেই হবে।
রিসোর্টে এসেও ঘরে ঢুকে পড়তে মন চাইছিলো না। পাশেই একটা ছোট্ট কয়েকটা ঘর বাড়ি দেখতে পেলাম। বেরিয়ে পড়লাম ক্যামেরা হাতে নিয়ে , কিছু অনাবিল আনন্দের ছবি তুলতে। যা পেলাম তা মনের কুঠুরিতে চিরজীবনের সম্পদ হয়ে রয়ে যাবে। কিছু মুহূর্ত আপনাদের সঙ্গে ওপরে ভাগ করে নিলাম।শেষে বলি , বিচিত্রপুর জায়গাটা হয়তো খুব ছোট্ট , কিন্তু তার সৌন্দর্য আর বাহারের ব্যাপ্তি বিরাট। জায়গাটা আরো বেশি প্রাণবন্ত হয়তো এই জন্যেই যে এখনো অন্যান্য জায়গার মতন অতটা জনপ্রিয় নয়। তবে যদি ওই বেরিয়ে পড়ি বেরিয়ে পড়ি নেশা টা চেপে বসে মাথায় , তাহলে বিচিত্রপুর কে নিজের গন্তব্য বানিয়ে ফেলতে দ্বিধা করবেন না।