সালটা ১৯০৪ বা ১৯০৫ হবে। অবিভক্ত বাংলার কলকাতা শহরের একটি সুসজ্জিত অনুষ্ঠান ভবনের সামনে অল্প অল্প করে আমন্ত্রিতদের ভিড় জমতে শুরু করেছে। ঠিক তার প্রকান্ড গেটের সামনেই একটি মধ্য তিরিশের লোক খুব সাধারণ পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন।হটাৎ দেখলে আমন্ত্রিত বলে ভুল হতে পারে। সন্ধে বাড়তেই ভদ্রলোক আমন্ত্রিত অভ্যাগতদের থেকে এগিয়ে গিয়ে কথা বলে সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগলেন। হাতে একটি মাটির পাত্র নিয়ে তার মধ্যেই সবার কাছে তিনি চাঁদা চাইছিলেন। অনেকেই অবাক হলেন কারণ এরকম একটি সাজানো গোছানো জাঁকজমক পুরোনো পরিবেশে তাকে দেখে। ভদ্রলোকের তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বেশিরভাগ লোকজন তাচ্ছিল্য পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। হটাৎ একজন তাকে চিনতে পেরে এগিয়ে গিয়ে আঁতকে উঠে বললেন - ডাক্তারবাবু ,আপনি? লোকটির এরকম কথায় আসে পাশের অনেকেই এগিয়ে এলেন ঘটনাটা কি সেটা জানতে। সাহায্যপ্রার্থী ভদ্রলোক একটু অস্বস্তি তে পড়ে কাউকে কিছু না বলে সেখান থেকে সরে অন্যদিকে প্রস্থান করলেন। খানিক পরে ফিরে এসে যথাস্থানে আবার দাঁড়ালেন। এর মধ্যেই প্রধান ফটকে প্রচুর লোক একত্রিত হয়েছেন কারণ বরের আগমন আসন্ন। মোটরগাড়ি থেকে বর নামতেই স্বাভাবিক নিয়মে তার অভ্যর্থনা আর আচার অনুষ্ঠান এগোতে লাগলো। বরের বাইরের সাজ সজ্জা খুব পছন্দ হওয়ায় একটু এগিয়ে যেতেই অনেক চোখে পড়লো যে এক ভদ্রলোক হাতে মাটির পাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গেটের কাছে। উনি যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তৎক্ষণাৎ প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওই ভদ্রলোকের পায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন - স্যার , আপনি এখানে এই পাত্র হাতে কি করছেন? চারিদিকে কেমন একটা থম মারা অবস্থা হলো। ভদ্রলোক মৃদু ভর্ৎসনা করে বর বাবাজীবন কে উঠে দাঁড়াতে বললেন। তবে বর শোনার পাত্র নন ,উনি কারণ শুনে তখুনি নিজের পরনের সোনার হার টি খুলে ওই পাত্রে দান করলেন। বললেন - ইনি আমার রক্ষাকর্তা , যিনি আমার মা কে মারণ প্লেগের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। সকলে আশ্চর্য হয়ে গেলেন কথা শুনে এবং যে যেরকম সামর্থ অকৃতদার হয়ে দান করতে লাগলেন পাত্রে। আজকে আমাদের গল্প এই সিংহ হৃদয় ডাক্তার কে নিয়ে। তার নাম রাধা গোবিন্দ কর। সংক্ষেপে আর জি কর।
কথায় বলে অলরাউন্ডার । কথাটা কর মহাশয়ের জন্যেই বোধহয় তৈরী করা হয়েছিল। একাধারে ডাক্তার ,নাট্যকর্মী ও সমাজ সংস্কারক। প্রত্যেক রূপে তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর কাজের জন্যেই বোধ হয় তাকে ¨রেনেসাঁ ম্যান অফ বেঙ্গল ‘বলে ডাকা হতো।
হাওড়া জেলার রামরাজাতলা রেল স্টেশন থেকে ১৫ মিনিট হাঁটা পথেই পড়বে বেতরের বিখ্যাত কর পরিবারের বিশাল অট্টালিকা। ঐতিহাসিক বাড়িটি তৈরী হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধের এক বছর আগে ,অর্থাৎ ১৭৫৭ সনে। এই বাড়িতেই ২৩ য়ে অগাস্ট ,১৮৫০ সালে জন্ম নিলেন রাধা গোবিন্দ কর। পিতা প্রখ্যাত চিকিৎসক ড. দুর্গাদাস কর। প্রসঙ্গত এই দুর্গাদাস কর মহাশয় ঢাকা তে মিডফোর্ড হাসপাতালটি তৈরী করেছিলেন।
রাধা গোবিন্দ নিজের স্কুলের পড়াশুনো কলকাতার হেয়ার স্কুলে করেন। দুর্গাদাস আগেই নিজের ছেলের জন্য পথ বেছে নিয়েছেন। ছেলে হবে তার মতন ডাক্তার। রাধা গোবিন্দ কে তিনি ডাক্তারি এন্ট্রান্সের জন্য তৈরী হতে বললেন। এদিকে রাধাগোবিন্দর থিয়েটার নাটক ইত্যাদি তে খুব নেশা। কিন্তু বাবার মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস তিনি করলেন না এবং মেডিকেল কলেজে পড়াশুনো শুরু করলেন। ভাগ্গিস করেছিলেন নাহলে হয়ত ভারতের রাধা গোবিন্দর মতন একজন গুণী ডাক্তার আর ভালো চিকিৎসক পাওয়া হতো না।
দুর্গাদাস মহাশয় রাধাগোবিন্দের পড়াশুনোর সুবিধার্থে কলকাতার শ্যামবাজারে একটি বাড়ি তৈরী করে দিলেন। দুর্গাদাস বাবু নিজে খুব মেধাবী ছিলেন এবং ডাক্তারি ছাড়াও কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভাষা বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। ডাক্তারির প্রচুর বই তিনি বাংলাতে অনুবাদ করেছিলেন এবং লিখেছিলেন। রাধাগোবিন্দ নিজের পিতা কে দেখেই বোধ হয় বুঝেছিলেন যে ডাক্তারি পড়াতেও মাতৃভাষার মাহাত্ম আছে। ওনার জীবন জুড়ে দুর্গাদাস বাবুর অনুপ্রেরণা চোখে পড়ে।
ছাত্রাবস্থায় রাধাগোবিন্দ থিয়েটার আর নাট্য জগতে খুব উৎসাহী ছিলেন। দুর্গাদাস বাবুর পারিবারিক বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র মহাশয়। মূলত ওনাকে দেখেই রাধাগোবিন্দ নাট্য জগতে প্রবেশ করেন। নিজের আরো বন্ধু যেমন গিরিশ চন্দ্র ঘোষ ,অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি এবং নগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ১৮৬৮ সালে স্থাপনা করেন বাগবাজার এমেচার থিয়েটার দলের। রাধাগোবিন্দ ডাক্তারি পড়ার পাশাপাশি চুটিয়ে থিয়েটার করতে লাগলেন। ১৮৭২ সালে মঞ্চে দীনবন্ধু মিত্রের লীলাবতী নাটকে ক্ষিরোদবাসিনীর চরিত্রে অভিনয় করে প্রচুর সুনাম অর্জন করেন।কিন্তু গোল বাঁধলো একটি জায়গায়। তার মন ডাক্তারি পড়াশুনো থেকে সরে বেশি করে নাটকের দিকে চলে যেতে লাগলো। রাধাগোবিন্দের বিবাহ ছাত্রাবস্থাতেই হয়ে গেছিলো। দুঃখের বিষয় যে ওনার স্ত্রী বিবাহের কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান। বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে যাতে রাধাগোবিন্দের পড়াশুনোর কোনরকম ক্ষতি না হয় সে জন্যে তার পরিবার সিদ্ধান্ত নিলেন যে তাকে স্কটল্যান্ডে পড়তে পাঠানো হবে। ১৮৮৩ সালে এডিনবরা ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হলেন তিনি। ডাক্তারি পড়া শেষ করে এডিনবরা ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন ১৮৮৭ সালে।
১৮৮৭ সালে কলকাতার চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন ছিল জানেন? ঊনিশের শতকের মাঝামাঝি মেডিকেল কলেজ তৈরী করা হয়েছিল। ব্রিটিশদের দেশি চিকিৎসা পদ্ধতিতে একদম বিশ্বাস ছিল না কলিকাতা মেডিকেল কলেজ বানানো হয়েছিল মূলত ইউরোপীয় চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচার এই দেশে করতে। সেটা কিন্তু নিজেদের রাজত্ব কায়েম করার একটি পন্থা ছিল। তাই ব্রিটিশ সরকার নিজেদের স্বার্থেই এই কলেজ প্রতিষ্টা করেছিল। বাঙালি ডাক্তাররাও তখনকার দিনে ইউরোপীয় পদ্ধতি ও ধ্যান ধারণাতেই দীক্ষিত হতেন। ব্রিটিশ ডাক্তাররা যখন একটা দেশি ডাক্তারদের দল তৈরী করতে চাইলেন তখন অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালো ভাষা। হিন্দু কলেজ থেকে যারা আসছিলেন তারা ইংরেজি জানলেও বাকিদের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানেরও কোনো বাংলা বই পাওয়া যেত না। রাধা গোবিন্দ দেখেছিলেন সহপাঠীদের ইংরেজি তে হোঁচট খেতে , বিপাকে পড়তে। তিনি স্থির করলেন এই সমস্যা তিনি সমাধান করবেন। বাংলায় অনুবাদ ও রচনা করলেন প্রচুর দরকারি ডাক্তারির বই। প্রথম বই ভাষাবন্ধু প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭১ সালে।তার পরেও প্রচুর বই লেখেন যেমন রোগী পরিচয় ,বিশাখা সুহৃদ ,কবিরাজ ডক্টর নিউস,কনসিয়স ফিজিওলজি ,প্লেগ ইত্যাদি। এমন ভাবে লিখতেন যাতে সাধারণ ছাত্র এবং মানুষ পড়ে সহজেই বুঝতে পারে। ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হলো তার লেখা বইগুলো। প্রায় সবাই তার বই পাঠ্যবই হিসেবেও ব্যবহার করতেন। রাধাগোবিন্দ এই কাজের অনুপ্রেরণা কিন্তু পেয়েছিলেন নিজের পিতার কাছ থেকে। দুর্গাদাস মহাশয় মনে মনে এই ইউরোপীয় শিক্ষা ব্যাবস্থা ভারতীয়দের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধী ছিলেন। যদিও নিজে ইংরেজি তেই পড়াশুনো করেছেন তবুও তিনি ব্রিটিশদের এই প্রাচীন ভারতীয় ধ্যান ধারণা এবং শিক্ষাব্যবস্থা মুছে দেয়ার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। ১৮৬৮ তে লিখেছিলেন ভাসেয্য রত্নাবলী যা মূলত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা এবং তার গুণাবলী নিয়ে লেখা হয়েছিল। বৈদ্যদের কাছে এই বই ছিল অমূল্য। রাধাগোবিন্দ পরবর্তী কালে নিজের পিতার বই সংশোধন করে নতুন এডিশন বার করেন।
রাধাগোবিন্দ লক্ষ্য করলেন যে বই লিখলেই হবেনা। বাঙালি ডাক্তাররা তখন এক গভীর দোটানায় পড়েছিলেন।কলেজে শেখা ইউরোপীয় পদ্ধতি তে চিকিৎসা করবেন না আয়ুর্বেদ পদ্ধতি তে করবেন। এই সমস্যা মেটাতে প্রয়োজন ছিল একটি আলাদা মেডিকেল কলেজের। দেশে ফেরা ইস্তক রাধাগোবিন্দ কলকাতায় একটি ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট খোলার চিন্তা ভাবনা শুরু করেন।১৬১ নম্বর, পুরাতন বৈঠকখানা বাজারের বাড়িতে তাই তিনি একটি সংগঠন তৈরী করেন তখন কার দিনের নাম করা ডাক্তার দের নিয়ে। ড.মহেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ,ড.অক্ষয় কুমার দত্ত ,ড.বিপিন বিহারি মৈত্র ,ড.এম এল দে ,ড. বি জি ব্যানার্জী ও আরো অনেকে সেই এসোসিয়েশনে ছিলেন। এই এসোসিয়েশনেই কথা ওঠে এশিয়ার প্রথম প্রাইভেট মেডিকেল স্কুল স্থাপনের।১৮৮৬ সালে সেই স্কুল পথ চলা শুরু করে। নাম হয় ক্যালকাটা স্কুল অফ মেডিসিন। শুরু তে খাঁটি ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি শেখানো হতো। অ্যালোপ্যাথি বিভাগ শুরু করা হয় ১৮৮৭ সালে এবং স্কুলের নাম বদলে রাখা হয় ক্যালকাটা মেডিকেল স্কুল। পরবর্তী কালে স্কুল স্থান পরিবর্তন করে বৈঠকখানা বাজার থেকে চলে আসে বউবাজার স্ট্রিটে।
রাধাগোবিন্দ গোড়াপত্তন করে ফেলেছিলেন এবার শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ সরকার মেডিকেল স্কুলে অটোপসি করার ছাড় দিলো। ক্যালকাটা মেডিকেল স্কুলে তখন ড.রাধাগোবিন্দ কর আর ড.মধুসূদন গুপ্তের লেখা বই পোড়ানো হচ্ছিলো এবং দিনে দিনে জনপ্রিয় হচ্ছিলো। বড় জায়গার প্রয়োজনে স্কুলের স্থান আবার পরিবর্তন করা হলো। এবার ঠিকানা হলো ২৯৮ আপার সার্কুলার রোড। কিন্তু সেখানেও বেডের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪টি। স্কুল বেলগাছিয়াতে ১২ বিঘা জমি কিনলো। ১৮ হাজার টাকা পাওয়া গেলো প্রিন্স আলবার্ট ভিক্টরের ভারত সফরের তহবিল থেকে। মেডিকেল স্কুল পুনর্নির্মাণ হলো নিজস্ব জায়গায়। ভেবে দেখুন কতটা গুরুত্ব ছিল এই স্কুলের যে ব্রিটিশ শাসনে ভারতের মাটিতে সম্পূর্ণ ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছিলো ভারতের পরবর্তী চিকিৎসকদের।
১৮৯৮ সালে আরো বিস্তার ঘটলো স্কুলের। ২৫ হাজার টাকা দিয়ে আরো জায়গা কিনে প্রায় ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ৩০টি বেডের একটি আধুনিক হাসপাতাল গড়ে উঠলো। তখন কার দিনে এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ ছিল। ১৮৯৯ সালে সেই হাসপাতাল উদ্বোধন করেন বাংলার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জন উডবার্ন ,সঙ্গে ছিলেন ড.মহেন্দ্রলাল সরকার এবং রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়। কিন্তু হাসপাতালটি কাজ করা শুরু করে ১৯০২ সাল নাগাদ। বাবু মানিক লাল সীল হাসপাতালে একটি ডিসপেনসারি খুলতে অর্থসাহায্য করেন। রাধাগোবিন্দ করের প্রথম প্রাইভেট মেডিকেল স্কুল গড়ার কিছু বছর পরেই আরেকটি স্কুল তৈরী হয় যার নাম কলেজ অফ ফিজিসিয়ান্স এন্ড সার্জনস অফ বেঙ্গল। ১৮৯৫ সালে শুরু হওয়া এই প্রতিষ্ঠান কে ১৯০৪ সালে রাধাগোবিন্দ মহাশয়ের স্কুলের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হয়। ১৯১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ডাক্তারির এই শাখা কে কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ে মান্যতা দেয়া হয়। এই কলেজ কে রাধাগোবিন্দ মহাশয়ের নামে নামাঙ্কিত করা হয় স্বাধীনতার এক বছর পরে।
কিন্তু জানেন কি রাধাগোবিন্দর এই মহান কর্মকান্ডে সব থেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তার নিজের লোকেরাই। হ্যাঁ , ঠিক শুনলেন। বাংলার তখনকার দিনের বুদ্ধিজীবী মহল সব থেকে বেশি বাধা তৈরী করেছিল এই স্কুল তৈরী করতে। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় রাধাগোবিন্দ বাবু কে না এগোনোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন একটি স্কুল তৈরী করা আর একটি মেডিকেল স্কুল তৈরী করা এক কথা নয়। কিন্তু রাধা গোন্দিন্দ বাবু ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন। নিজের ডাক্তারের দায়িত্ব পালন করে এবং নিজের দৈনদ্দিন কাজ সামলেও অর্থ জোগাড় করার অকালন্ত চেষ্টা তিনি করে গেছেন। রাধাগোবিন্দ বাবু কে প্রায়ই বিভিন্ন বিয়ের অনুঠানের জায়গায় পাওয়া যেত অর্থ সাহায্য প্রার্থনা করতে যাতে এই মেডিকেল স্কুল তৈরী করা যায়। অনেক অপমান ,বিদ্রুপ আর টিটকিরি তাকে সহ্য করতে হয়েছে।
ড.রাধা গোবিন্দ কর নিজের সব উপার্জন এই স্কুল তৈরী করতে দেন করেন।তার মৃত্যুর সময় তার কাছে প্রায় কিছুই ছিলোনা। বেলগাছিয়ায় একটি মাত্র বাড়ি ছিল ,সেটিও তিনি দান করেছিলেন।উইল করে গেছিলেন যে তার দ্বিতীয় স্ত্রী তার জীবদ্দশায় এই বাড়ির মালিক থাকবেন কিন্তু তার মৃত্যুর পরে এই বাড়িতে দুর্গাদাস আরোগ্য নিকেতন গড়ে তোলা হবে তার বাবা কে শ্রদ্ধা জানাতে। ড.রাধাগোবিন্দ কর ইনফ্লুয়েঞ্জা তে আক্রান্ত হয়ে ১৯ ডিসেম্বর , ১৯১৮ সালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
দুঃখের বিষয় যে এক শতক হয়ে গেলেও তার জীবনের অকল্পনীয় এবং অসামান্য কাজের কোনো কৃতিত্ব তিনি পাননি। বাঙালিরা তার জীবৎকালে বা অবর্তমানে তার অবদান মনে রাখেনি। কিন্তু হয়তো বাংলার আরেক প্রবাদ প্রতিম চিকিৎসক বুঝেছিলেন এবং তার প্রাপ্য সম্মান তিনি দিয়েছেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতার একজন অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি ঘোষণা করেন যে তিনি ২ লক্ষ টাকা দান করবেন বেলগাছিয়া মেডিকেল কলেজ ফান্ডে কিন্তু তিনিই এই শর্তে টাকাটা দেবেন যে কলেজিটি যেন তার পরিবারের একজনের নাম নামকরণ করা হয়। অর্থাভাবে কলেজ কমিটি এই প্রস্তাব এ রাজি হয় , কিন্তু ড. বিধানচন্দ্র রায় এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন যে কলেজের নাম তার প্রবর্তকের নামেই থাকবে এবং অর্থ সংকুলানের ব্যবস্থা করেন । একটি মানুষের সারা জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমে আর প্রচেষ্টায় আজ লক্ষ লক্ষ রুগীর জীবন সুস্থ হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এটাই যে আজও আমরা এই সিংহহৃদয় লোকটিকে তার প্রাপ্য সম্মান জানাতে পারিনি। আজকের দিনে তাই তিনি একটি হাসপাতালের নাম হয়েই রয়ে গেছেন।